সর্বশেষ

34.4 C
Rajshahi
বুধবার, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

ডায়াবেটিস রোগীর খাবার রোজায় কেমন হবে ?

পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি একটু করে যেন শুরু হয়ে গেছে। কারণ রোজার শুরু হতে আর বেশি  দিন বাকি নেই। বছরের এই একটি মাস হলো সংযমের মাস। সাধারণের  মানুষের জন্য মেনে চলা সহজ হলেও ডায়াবেটিস রোগীরা পড়েন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। রোজা রাখতে পারবেন কি না বা রোজা রাখতে হলে বিশেষ কোনো সতর্কতা আছে কি না তা নিয়ে অনেক বেশি  চিন্তিত হন তারা।

ডায়াবেটিস  হলো এমন একটি রোগ যার সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও জীবনমানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খাবারের ক্ষেত্রে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অনেক বেশি  নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সেইসঙ্গে করতে  হয় সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনও।

রমজানে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনেকগুলো পরিবর্তনও ঘটে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ঘটে খাবারের ধরন এবং খাবার গ্রহণের সময়ের ক্ষেত্রে। তবে বিশেষ কিছু সতর্কতা ও একটু নিয়ম মেনে চললে একজন ডায়াবেটিস রোগীও নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারবেন।

ঝুঁকির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিস রোগীদেরকে ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

১। মডারেট রিস্ক গ্রুপ

২।  লো রিস্ক গ্রুপ

৩। হাই রিস্ক গ্রুপ

৪। ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপ

খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ও ওষুধ বা ইনসুলিনের মাধ্যমে যাদের ডায়াবেটিস বা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের লো ও মডারেট রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডায়াবেটিসের পাশাপাশি যারা অতিবৃদ্ধ এবং নানান রোগে আক্রান্ত (কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন; হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন; ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজ কমে  এবংবাড়ে; যথাক্রমে হাইপো ও হাইপারগ্লাইসেমিক হবার প্রবণতাও রয়েছে) তাদের হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

লো ও মডারেট রিস্ক গ্রুপের ডায়াবেটিস রোগীরা রমজান মাসের শুরুতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই রোজা রাখতে পারেন। অপরদিকে হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপের রোগীদের অবশ্যই একজন চিকিৎসক ও একজন পুষ্টিবিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থেকে রোজা রাখতে হবে।

রোজা পালনে ঝুঁকি রয়েছে  কী

সতর্কতা অবলম্বন না করলে অবশ্যই রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীদের বেশকিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন-

১। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে, এক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।

২। ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে  গেলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়ে যেতে পারে।

৩। কিটো এসিডোসিস বা হাইপার অসমোলার স্টেটও হতে পারে।

৪।রোজার কারনে  খুব কম পরিমাণে পানি বা ফ্লুইড জাতীয় খাবার খেলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এবং সেইসঙ্গে থ্রম্বোসিস ঘটতে পারে।

রোজা পালনে কারা ঝুঁকিপূর্ণ  ?

১। ঘন ঘন হাইপো এবং হাইপার গ্লাইসেমিক ডায়াবেটিক রোগী।

২। অনিয়ন্ত্রিত টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগী যারা।

৩। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগী যারা।

৪। অতিবৃদ্ধ ডায়াবেটিক রোগী যিনি।

৫। দীর্ঘমেয়াদী কিডনি জটিলতায় (বিশেষ করে স্টেজ ৩, ৪, ৫) বা ডায়ালাইসিস রোগী যারা।

৬। মারাত্মক সংক্রমণ, ক্যান্সার, যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী।

৭। দিনে একের অধিক ইনসুলিন নিতে হয় যাদের।

এছাড়াও স্ট্রোক,হার্ট অ্যাটাক,  অধিক কায়িক পরিশ্রমকারী ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

খাদ্য  ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ

পবিত্র রমজানে খাবার খাওয়ার সময়সূচীও পরিবর্তিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা এবং সময়সূচীও পরিবর্তিত হয়। এর মধ্যে কোনো রকম অনিয়ম হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক কমে বা বেড়ে যেতে পারে। তাই কোনো ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখতে চাইলে তাক অবশ্যই খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে যা করতে  হবে –

১। সেহরির শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খাবারটি গ্রহণ করতে হবে।

২। সেহরিতে লাল চালের ভাত, অথবা লাল আটার রুটি বা চিড়া বা ওটস, দুধ, কলা, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল রাখার চেষ্টা করতে হবে।

৩। ইফতারে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার, মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে।

৪।আপনার ইফতার শুরু করতে পারেন নবীজী (সঃ) এর সুন্নাহ্ ১টি খেজুর দিয়ে। এছাড়া কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত ফল অথবা ফলের জুস, টক দই, ডাবের পানি, চিড়া, একটা ছোট চাপা কলা, কাবাব, রুটি ইত্যাদি খেতে পারবেন।

৫। ডায়াবেটিক রোগীদের অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর তরল খাবার খেতে হবে, যেন পানিশূন্যতায় না ভোগেন।

৬। রাতে হালকা খাবার যেমন- স্যুপ বা লাল আটার রুটি, মাছ বা মাংস, ওটস, চিড়া খেতে পারেন।

৭। সেহরিতে অবশ্যই চেষ্টা করুন লাল আটার ভাত বা রুটিটি খেতে। সাথে রাখুন মাছ অথবা মাংস, সবজি, ডাল। এক গ্লাস দুধও খেতে পারেন, যা সারাদিনই আপনাকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করবে।

রমজানে একজন ডায়াবেটিক রোগী সেহরি, ইফতার, রাতের খাবারে কী কী খাবেন তার একটি তালিকা দেওয়া হলো-

সেহরি

ভাত- ১ থেকে ১.৫ কাপ

মাছ বা মাংসের- মাঝারি মাপের ১ টুকরা

সবজি- ১.৫ থেকে ২ কাপ (শুধু আলু ও মিষ্টি কুমড়া বাদে)

ডাল-১ কাপ (মাঝারি ঘনকার)

দুধ- ১ গ্লাস (২৫০ মিলি) অবশ্যেই।

ইফতার

খেজুর- ১ দিন পর পর ১টি (কিডনিজনিত সমস্যা থাকলে খেজুর এড়িয়ে চলবেন অবশ্যই )

ছোলা- আধ কাপ

মুড়ি- আধ কাপ

ফল- যেকোনো টক ফল বা ফলের জুস এবং  ডাবের পানি

টক দই- আধ কাপ

মাঝে মাঝে বাসায় রান্না করা চটপটি বা হালিমও খেতে পারেন ১ কাপের মতো।

রাতের খাবার

লাল আটার রুটি- মাঝারি সাইজের ২টি (অবশ্যই পাতলা)

মাছ বা মাংস- ১ টুকরা (মাঝারি সাইজের )

সবজি মিক্সড সবজি- ১.৫ থেকে ২ কাপ (অবশ্য মিষ্টি কুমড়া ও আলু বাদে)

ডাল – ১ কাপ (মাঝারি ঘন)।

(রোগী ভেদে খাবারের পরিমাণ ভিন্ন হবে। তাই একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতো রমজানের দৈনিক খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিতে হবে।)

ওষুধ ইনসুলিন

রোজা শুরুর আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধের মাত্রা ও সময়সূচী সমন্বয় করে নিতে হবে। যারা ওষুধ খান তারা সকালের ডোজ ইফতারের শুরুতেই এবং রাতের ডোজের অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খাবেন। আর যারা ইনসুলিন নেন, তারা সকালের ইনসুলিন ডোজটি ইফতারের আগে আর রাতের ডোজটি কিছু কমিয়ে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করবেন।

ব্যায়াম ও হাঁটা

রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত হাঁটা বা যেকোনো ভারী কাজ  না করাই ভালো। এ সময় ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও সময় নিয়ে তারাবীহ নামাজ আদায় করা রমজানে শারীরিক ব্যায়ামের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।

মনে রাখা জরুরি

১। রোগি রোজা রেখে কখনোই আগের মাত্রায় ওষুধ বা ইনসুলিন নেবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ বা ইনসুলিন সমন্বয় করতে যাবেন  না। এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে।

২। রোজায় ক্যালরিটা  ঠিক রেখে শুধু খাদ্য উপাদান ও খাওয়ার সময় পরিবর্তিত হবে।

৩। ইফতার এর সময় অতিভোজন এবং সেহরিতে অল্পভোজন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।

৪। সেহরিতে যে কোনো অবস্থায় না খেয়ে বা সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখা যাবে না।

৫। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টায়, বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টায়, ইফতারের ঠিক আগে ও ইফতারের ঠিক ২ ঘণ্টা পরে গ্লুকোমিটারে রক্তের গ্লুকোজ লেভেলের চার্ট অবশ্যই বানিয়ে ফেলতে হবে। রোজায় কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে বা রক্তের গ্লুকোজ লেভেলে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। রক্তের গ্লুকোজ লেভেল কমে ৩.৯ মিলিমোল/লিটারের নিচে এসে রোগী হাইপো হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে কখনোই তার মুখে চিনির পানি বা অন্য কিছু খাওয়াতে যাবেন না। এক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

লেখক: পুষ্টিবিদ, লিভ হেলদি বিডি।

 

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles