সর্বশেষ

37 C
Rajshahi
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

নওগাঁয় মুসাফিরদের আশ্রয় স্থান পোরশার মুসাফিরখানা

নওগাঁ প্রতিনিধি: শত বছর আগের কথা। সময়টা ছিল ১৯০৮ সাল। বনজঙ্গলে ঘেরা এবং উঁচু-নিচু বরেন্দ্র ভুমির এলাকা নওগাঁর পোরশা থানা। সে সময় ভাল রাস্তাঘাটও ছিলনা। ছিলনা চলাচলের জন্য কোন যানবাহন। পাঁয়ে হেঁটে চলতো মানুষজন। আর মেঠোপথে চলতে চলতেই হতো দুপুর, তারপর দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। তখনকার যুগে যেমন ছিল চোর-ডাকাতের উপদ্রব তেমনি ছিল হিংস্র বিভিন্ন প্রাণী ও বিচ্ছুর ভয়। এ এলাকার পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন সন্ধা নামতো তখনি মানুষ রাত যাপনের জন্য পোরশার গ্রামগুলিতে আশ্রয়ের স্থান খুঁজতো।

ওই সময় কাহারও ভাগ্যে নিরাপদ আশ্রয় মিলতো আবার কাহারও ভাগ্যে মিলতো ভোগান্তি আর কষ্ট। পথিক মুসাফির মানুষের ওই ভোগান্তি আর কষ্টের কথা চিন্তা করে শতবছর আগে তৎকালীন এই এলাকার জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ মুসাফিরখানা নাম দিয়ে তৈরি করেছিলেন টিনের ছাউনি সম্বলিত একটি মাটির ঘরের প্রতিষ্ঠান। পথিক মুসাফিররা যেন বিপদে আপদে এই ঘরে এসে আশ্রয় পান এবং তাদের রাত বা দিনে আশ্রয় এবং বিশ্রামের জন্যই এটি নির্মান করেছিলেন তিনি।

মুসাফিরদের রাত ও দিনে থাকার পাশাপাশি বিনামূল্যে খাবারেরও ব্যবস্থা করেছিলেন জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ্। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা এবং সকল ধরনের খরচ পরিচালনার জন্য তিনি মুসাফিরখানার নামে দান করেছিলেন প্রায় ৮০ বিঘা জমি। দানকৃত ওই জমির ফসল বিক্রি করে আয়কৃত অর্থ দিয়ে চালানো হয় প্রতিষ্ঠানটি।

পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে বিশিষ্ট আলেম ও সমাজসেবক আলহাজ্ব শরিফ উদ্দিন শাহ্ এর পরিচালনায় মুসাফির খানাটি দুইতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং এ উন্নীত করা হয়। এতে মুসাফিরদের জন্য ১৩টি বেড রুম সহ একটি মিলনায়তন, একটি রান্নাঘর, ও ৮টি দোকান ঘর রয়েছে। দোকান ঘর গুলি থেকে আয়কৃত অর্থ মুসাফিরদের জন্য খরচ করা হয়। বর্তমান সময়ে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার কারনে আর ভোগান্তি পোহাতে হয়না এই এলাকায় এসে। তারপরেও টিকে রয়েছে নওগাঁর পোরশা উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মুসাফিরখানাটি। দূর-দূরান্ত থেকে আগত মুসাফির পথিকদের আগের মতোই সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

পোরশা গ্রামের আনিসুর রহমান শাহ্ জানান, নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ১শ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পোরশা উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মুসাফিরখানাটি। তৎকালিন বাদশা আলমগীরের সময়ে ইরান থেকে শাহ্ বংশের ফাজেল শাহ, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ, মুহিদ শাহ, জান মোহাম্মদ শাহ, খান মোহাম্মদ শাহ ও ওমর আলী শাহ্ নামে আরো কয়েকজন মুরুব্বী স্ত্রী-সন্তান সহ হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন।

পরবর্তীতে বরিশাল থেকে তারা  পোরশায় আসেন। সে সময় এখানে কোন বসত-বাড়ি ছিলনা। চারিদিকে বন-জঙ্গলে ভরে ছিল কিন্তু এলাকাটি তাদের ভাল লাগায় এখানে তারা  ঘর বাড়ি নির্মান করে বসবাস করতে শুরু করেন বলে তিনি জানান। ওই সময় তাদের নিজেদের পারিবারিক ভাবে পারস্পরিক সন্তানের বিয়ে দিয়ে তারা বংশ বিস্তার করেন এবং প্রথাটি আজও চালু রয়েছে বলে তিনি জানান।

তবে ওই সময় এই এলাকায় তারা বসবাস শুরুর পর থেকে এখানকার জমি পেয়ে তাদের পরবর্তী বংশধররা এখানে জমিদারী করেন। তাদেরই বংশধর খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ ভারতের কলকাতা শহরের জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখোদা মসজিদের পাশে অবস্থতি মুসাফির খানার অনুকরণে এই মুসাফিরখানাটি নির্মান করেছিলেন বলে আনিসুর রহমান জানান।

মুসাফিরখানার ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য জন্য একটি কমিটি রয়েছে। বর্তমান পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী মঞ্জুরুল হক শাহ্। তিনি মুসাফিরখানার সকল বিষয়ে খোঁজ খবর নেন এবং দেখাশোনা করেন।

সিরাজুল জানান, তিনি এখানে প্রায় ২৭বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিদিনই এখানে অনেক মানুষ আসে এবং তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখানে প্রায় ৬০জন মানুষ একসাথে   থাকার ব্যবস্থা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

এছাড়াও অনান্য দিনের তুলনায় রমজান মাসে এখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০-৭০০ মানুষ ইফতার করে এবং ২০০-২৫০জন মানুষ ইপতার-সেহরি দুইটি খায় বলে জানান পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী মঞ্জুরুল হক শাহ্।

তিনি আরো জানান, ১৯০৮সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৮০ বছর মাটির ঘরেই এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে মুসাফিরখানার জমিজমা থেকে ও অন্যদেন দেওয়া অনুদান থেকে আয়কৃত টাকা দিয়ে বর্তমান ভবনটি নির্মান করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আসা করছেন।

সম্পাদনায়ঃ হাবিবা সুলতানা

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles