টপ নিউজ: একাত্তরে মুক্তিকামী মানুষদের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে-হিচড়ে নিয়ে আসা হতো। রাতভর অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন শেষে মুক্তি পিপাসুদের মৃত, অর্ধমৃত বা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত জীবন্ত দেহ ক্যাম্পের কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হতো ।আর এই দেহগুলো আশপাশের কোনো ভাগাড়, জলাশয়, ডোবা কিংবা গর্তে পরে ফেলে দেওয়া হতো । ঠিক এরকমই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির এক ইতিহাস রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে পূর্বদিকে কিছুক্ষণ হাঁটলে দেখা যাবে ইটের তৈরী একটি লাল স্তম্ভ যা বধ্যভূমি নামে পরিচিত । ১৯৭১ সালে রাজশাহীসহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকেপাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শিক্ষক-শিক্ষার্থী, যুবক-যুবতী ও মধ্য বয়সী নারী-পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতন করতো । শত শত নিরাপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যার পর জীবিত বা মৃত অবস্থায় গণকবর দেওয়া হতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদ শামসুজ্জোহা হলে পাক হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিলো । টানা ৯ মাস এই হলকে ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে তারা। হলের করিডোর ও কক্ষে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে বেধড়ক পেটানো হতো মুক্তি পিপাসু বাঙালিদের। তবুও তারা হার মানেনি। উচ্চারণ করেনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তাদের চোখে ছিলো বাঁচার স্বপ্ন, মুক্তির স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে না পারলেও মুক্তি এসেছে ঠিকই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণকবর বা বদ্ধভূমির একে একে সন্ধান মিলতে থাকে। এমন খবর শুনে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে স্বজন হারা মানুষেরা পঁচা, গলিত, অর্ধগলিত বিকৃত দেহাবশেষ খুঁজে বের করেছেন। কেউ পরনের জামা, হাতের ঘড়ি-আংটি, শারীরিক গড়ন বা বৈশিষ্ট্য দেখে খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রিয়জনদের। স্বাধীনতার পর রাবির বধ্যভূমির এই গণকবরে স্মতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য মাটি খুঁড়তেই পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য মাথার খুলি ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কঙ্কাল। আজও সেগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।
২০০০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এম. সাইদুর রহমান খান বধ্যভূমির স্মৃতিফলকের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। বধ্যভূমির সমতল ভূমি থেকে ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তর বিশিষ্ট একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
স্তম্ভ ঘিরে একটি কংক্রিটের বেদি এবং বেদির মাঝখানে বড় একটি কূপ। স্তম্ভের গায়ের কালো ছাপ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক। অন্যদিকে কূপটিকে ‘মৃত্যুকূপ’ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়।
স্মৃতিস্তম্ভটি ১৯৭১ সালের ভয়াল দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ার আহবান জানাচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, প্রতি মুহূর্তে তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করার জন্য এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে শহীদদের স্মৃতিও ততদিন বেঁচে থাকবে।
সম্পাদনায়: শাহনাজ সাফা