সর্বশেষ

30.8 C
Rajshahi
শনিবার, মে ৪, ২০২৪

রাজশাহীতে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ বালিশকাণ্ড-র মজিদের কব্জায়

টপ নিউজ ডেস্ক: রূপপুর বালিশকাণ্ড ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ করছে রাজশাহী মহানগরীতে। এর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দীর্ঘতম একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজও। 

যে প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কাজেই অভিযোগ রয়েছে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারসহ দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঢিলেমির, তাকে দিয়ে ১ দশমিক ২ কিলোমিটারের ফ্লাইওভার নির্মাণ কতোটা নিরাপদ হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্দেহ।

এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়েছে ঠিকাদারি কাজের নথিপত্র অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারসহ ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং দেখতে চান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেও।

দুদকের রাজশাহী জেলার উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবন ধসের ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করছে দুদকের জেলার একটি টিম। ভবন নির্মাণের প্রকৌশলীও রয়েছে ওই টিমের সাথে। দুদকের উপ-পরিচালক আরো জানান, ভবনটির কারিগরি ত্রুটি চিহ্নিত করতে সঙ্গে রাখা হয়েছে সিভিল বিভাগের প্রকৌশলীদের। তদন্ত শেষে কাউকে অভিযুক্ত পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার বিরুদ্ধে।

সিটি কর্পোরেশনের ‘মজিদপ্রীতি’: ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক। এ প্রকল্পে করা হবে ১০৭ ধরনের কাজ। নগরীতে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ এর মধ্যে ছিলো।

সেবছরই সম্পন্ন করা হয় ফ্লাইওভারগুলোর নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া। ২০২২ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয় এর নকশা চূড়ান্ত করা হলে। গত বছর দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে রাজশাহী মহানগরীর বর্নালী মোড়, বন্ধগেট ও বিলিসিমলা রেলক্রসিং এলাকার প্রায় ১ কিলোমিটার ২৫৫ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পায় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন। সম্প্রতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু করেছে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, ৫টি ফ্লাইওভারের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে দেয়ার ব্যাপারে দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের ওপর শুরু থেকেই চাপ ছিলো। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও ওয়াসায় বিভিন্ন কাজ পায় প্রভাবশালী একটি মহলের বিশেষ আগ্রহেই এই মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন।

এর ধারাবাহিকতায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একটি ফ্লাইওভার ছাড়াও শালবাগান কাঁচা বাজার ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণের কাজও দেয়া হয় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে। প্রথম আলোচনায় আসে মজিদ সন্স ২০১৯ সালে বালিশকাণ্ড দিয়ে।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে অভিযোগ ওঠে আসবাবপত্র সরবরাহে অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি ও কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয় বলে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা ব্যয় দেখানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া এ ঘটনা পরিচিতি পায় ‘বালিশ দুর্নীতি’ হিসেবে।

২০১৯ সালের মে মাসে এই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নথি প্রকাশ করা হয়। তখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনস্থ পাবনা পূর্ত শাখার কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়মূল্যের নথিতে উল্লিখিত ব্যয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই কেনাকাটার তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায়।

এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ধসে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের ছাদের অংশ। এই অংশটি ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত ছিল। স্পেশাল কোয়ালিটির শাটারিং দরকার হলেও জটিল এই কাজে, তা দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া সময় লাগে কনক্রিটের জমাট বাঁধতে, কলাম ও বিম ঢালাইয়ের পর সেই সময়টাও দেওয়া হয়নি। ঢালাই শক্ত হওয়ার আগেই শুরু হয় নতুন করে ঢালাই দেওয়া। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই গাফিলতি আলোচিত হয় তখন দেশজুড়ে।

এতোকিছুর পরেও রাজশাহী সিটি করপোরেশন সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর কীভাবে  আস্থা রাখছে জানতে চাইলে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, সরকার তো তাদের কালোতালিকাভুক্ত করেনি, তাই কিছুই করার নেই আমাদের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন হলের ছাদ ধসের ঘটনার পর তাদের ব্যাপারে আমরা বেশ সতর্ক। কাজের ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তাদের সিমেন্ট ও রডের মান। সার্বক্ষণিক তাদের কাজ তদারকি করছে আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী।

ঢাকার মহাখালী এলাকার নিউ ডিওএইচএসে অবস্থিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড কাজ করছে রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে ৫৪৭ কোটি টাকার।

প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজশাহী ওয়াসায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ ৪৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট)১০ তলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে, ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ ৬৪ দশমিক ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে, ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ে ২০ তলা কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ভবন, ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা এএইচএম কামারুজ্জামান হল নির্মাণ, ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার,৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ।

নির্মাণাধীন ওয়াসা ভবনের প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, ২০২২ সালের জুন মাসে মজিদ সন্সকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়। ২০২৩ সালে ম্যাট ঢালাইয়ের জন্য তারা যে রড ব্যবহার করতে চেয়েছিলো, তা অনুমোদিত রড নয় পিডব্লিউডি। পরীক্ষা করে ধরা পরে যে, ওই রডের মান অনেক কম পিডব্লিউডির নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে। এরপর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঢিলেমির কারণে কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুদফা।

ওয়াসার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দরপত্র প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তাদের ওপর চাপ ছিলো এই কাজটি মজিদ সন্সকে দেয়ার জন্য। সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও তার স্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ ছিলো কাজ পাইয়ে দিতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে। ওয়াসার সূত্র জানিয়েছে, এ কারণেই মজিদ সন্সের গাফিলতির বিষয়টি তাদের বিড়ম্বনায় ফেললেও বেগ পেতে হয় সরাসরি ব্যবস্থা নিতে।

রুয়েটের একটি সূত্রে জানা যায়, এখানেও সরকারি দলের প্রভাবশালী এক নেতার চাপে দুটি নির্মাণকাজ পেয়েছে মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন। এই ক্যাম্পাসে নিয়োগ ও ঠিকাদারি কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে ওই নেতা ও তার পরিবারের নির্দেশ পালন করার অভিযোগ আছে তৎকালীন উপাচার্যর বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে সাবেক সেই উপাচার্যর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদকও।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ওই কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশে সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের আমলে শহিদ কামারুজ্জামান আবাসিক হলের নির্মাণকাজটিও মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে দেয়া হয়। কাজটি শুরুর পর থেকেই নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সবশেষ নির্মাণকালে ছাদের ঢালাই ধসে পড়লে দেশজুড়ে আলোচিত হয় বিষয়টি।

দুদক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন নির্মাণ কাজ কীভাবে পেল এবং কীভাবে তারা কাজগুলো করছে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা এগুলো সব খতিয়ে দেখার জন্য।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles